কাজী আশরাফ: পৃথিবীর সব প্রতিবাদ সফল হয় না। আবার সব আন্দোলন এক সময় থেমে যায় সময়ের আবর্তে। তারপরও নিষ্পেশিত, বঞ্চিত, শোষিতরা একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় অধিকার আদায়ের দাবিতে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরতি দাবি নিয়ে একটি জাতি বুক পেতে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীনদের বুলেটের সামনে। বিবেকের ডাকে সারা দিয়ে অনেকে সামিল হয় সেই প্রতিবাদে। তখন প্রতিবাদের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর কোণায়, কোণায়। আর তখনই প্রতিবাদ পরিণত হয় আন্দোলনে। এক সময় সেই আন্দোলন পরিণত হয় ইতিহাসে। তেমনই ১০টি আন্দোলন নিয়ে প্রিয়আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি এই লেখা।
গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ : পূর্ণ স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কয়েকটি জাতীয় দাবি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলনের সংকল্প করেন। প্রথমে তিনি লবণ আইন অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ৭৯ জন সত্যাগ্রহী নিয়ে তিনি সাবরমতী আশ্রম থেকে সমুদ্রতীরবর্তী ডাণ্ডি অভিমুখে যাত্রা করেন। ২৪১ মাইল পথ অতিক্রম করে ৫ এপ্রিল গান্ধীজি ডাণ্ডি পৌঁছান। পরদিন ভোরে সমুদ্র উপকূলে দাঁড়িয়ে একমুঠো লবণ সংগ্রহ করে তিনি আবগারি আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। লবণ আইন ভঙ্গ করে আন্দোলনের সূচনা হয় বলে জাতীয় এই আন্দোলন ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ নামেও পরিচিত।
কালোদের বাস বয়কট : মন্টেগোমারির ৭০ শতাংশ বাসযাত্রী ছিল কালো আমেরিকান। কিন্তু কালোদের সব সময়ই সাদাদের আসন ছেড়ে দিতে হতো। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরের পয়লা তারিখ বাসে বসা নিয়ে রোজা পার্ক নামের এক কালো আমেরিকান একজন সাদা বাস যাত্রীকে আসন ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৈষম্যমূলক আচরণে গোটা মন্টেগোমারিতে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে জনতা। কালোরা বয়কট করে বাসযাত্রা। তাদের সঙ্গে একাত্ততা পোষণ করেন অনেক সাদাও। ওই ঘটনার এক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে ঘোষণা করে বাসের আসন নিয়ে সাদা ও কালোর কোনো প্রভেদ করা যাবে না।
সাদাদের পাশে তখন কালোরা বসতে পারতো না
বার্লিন দেয়াল ভাঙার ডাক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে আলাদা হয়ে গিয়েছিল জার্মানি। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির রাজনৈতিক ভিন্নতার প্রতীক বার্লিন দেয়াল নির্মিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে বার্লিনের মাঝখান দিয়ে। দেয়াল তুলে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ জার্মানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা। রাজনৈতিক ভিন্নতার শিকার হয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি হয়েছিল বন্ধ। আশির দশকের শেষ দিকে পূর্ব জার্মানি নিজেদের রাজনৈতিক নীতির উদারীকরণ শুরু করে। ১৯৮৯ সালে সমগ্র পূর্ব ইউরোপে যখন উদার নীতির জয়গান চলছে, ঠিক তখনই পূর্ব জার্মানি পশ্চিমের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে বছরের ৯ নভেম্বর হাজার হাজার জার্মান বার্লিন দেয়ালের কাছে জড়ো হয়ে দেয়ালটি ভেঙে ফেলতে উদ্যত হয়। তারা দেয়ালের ওপর উঠে নেচে-গেয়ে ২৮ বছরের বিচ্ছেদের প্রতিবাদ জানায়। ভেঙে ফেলে সেই বিচ্ছেদের সৌধ। পরের বছর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে দুই জার্মানির মধুর মিলন ঘটে।
কালোদের নাগরিক অধিকার : ১৯৫৫ সালে মন্টেগোমারিতে বাসের আসন নিয়ে প্রতিবাদের আট বছর পর ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র কেঁপে ওঠে কালোদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। এই লক্ষে ওয়াশিংটন অভিমুখে একটি মিছিল শুরু করে নাগরিকেরা। সেই মিছিলের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ছিল কালো আমেরিকান। তাদের সেই আন্দোলন মার্কিন সরকারকে বাধ্য করে ১৯৬৪ সালের নাগরিক অধিকার আইনের খসড়া প্রণয়নে। এই প্রতিবাদ, এই আন্দোলন বিখ্যাত হয়ে আছে মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ উক্তিসংবলিত বক্তৃতার জন্য।
বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও : একটা সময় পর্যন্ত সাবেক চেকোস্লোভাকিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের অধীন ছিল। দেশটির বেশি ভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই ঠিক করে দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন। চেকোস্লোভাকিয়ার ‘স্লোভাকিয়া’ অংশের মানুষ নির্দিষ্টভাবে ছিল সোভিয়েত আধিপত্যের সবচেয়ে বড় শিকার। স্লোভাক রাজনীতিক আলেকজান্ডার দুবেক চেকেস্লোভাকিয়ার ক্ষমতায় বসে এই বিষয়টির বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। তিনি গণমাধ্যম ও জনগণের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন (১৯৬৬), কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়া। প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে জনগণ। রাশিয়া তখন চেকোস্লোভাকিয়া অভিমুখে সেনাদল পাঠিয়ে সে আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করে।
তুলে দেওয়া হচ্ছে বিভেদের বার্লিন দেয়াল
১৯৬৮ এর ছাত্র বিক্ষোভ : ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামে তখন আগ্রাসন চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধ ও আগ্রাসনের ভয়াবহতা পৃথিবীব্যাপি তরুণ প্রজন্মকে যুদ্ধবিরোধী করে তোলে। অন্যদিকে কালো আমেরিকানরা লড়ছে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। তাদের আন্দোলনও পৃথিবীর নানাপ্রান্তে তরুণদের উৎসাহিত করেছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। উত্তর আয়ারল্যান্ড ফুঁসে উঠেছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। পুরো আফ্রিকাজুড়ে তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দানা বেধেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের হাতছানি তখন দেশ থেকে দেশান্তরে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট’ মনোভাব তখন তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছে দ্রোহের আকাঙ্ক্ষায়। নানা প্রতিবাদে সরব তখন ছাত্র সমাজ।
জনগণের প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শোষকের যান
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে : ভিয়েতনাম যুদ্ধ লজ্জা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। দেশটির সুশীল সমাজ, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখ ভিয়েতনামে মার্কিন সরকারের যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে লাখো জনতা। ধীর পায়ে হেঁটে শান্তির বারতা ঘোষণা করে তারা। সে দিন মিছিলের সঙ্গে হেঁটে তাতে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল হাজার হাজার পুলিশও। জন লেনন গেয়েছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান, ‘গিভ পিস অ্যা চান্স!’
তিয়েনআনমেন স্কয়ার : ১৯৮৯ সালের জুন মাসে কমিউনিস্ট চীন কেঁপে ওঠে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে। এর আগে ১৫ এপ্রিল নিহত হন চীনের সুশীল সমাজের অন্যতম অগ্রনায়ক ও সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হু ইয়াওব্যাং। তার মৃত্যুর পর থেকেই ছাত্র, জনতা ও পেশাজীবীরা প্রতিবাদ জানাতে থাকে বিভিন্নভাবে। জুন মাসে রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে এ বিক্ষোভের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ সময় তিয়েনআনমেন স্কয়ারে জমায়েত হয়ে উদার নীতির আদর্শে উদ্ভাসিত প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ চীন সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ জানায়। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে চীন সরকার সামরিক আইন জারি করে কঠোর দমননীতির আশ্রয় নেয়। অনুমান করা হয়, চীন সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় প্রায় কয়েক হাজার প্রতিবাদী মানুষকে সে দিন হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল।
ট্যাংকের সামনে সাহসী সেই নাম না জানা মানুষের প্রতিবাদ
লাল শার্টধারীদের বিক্ষোভ : থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ ভেজ্জাজিভার পদত্যাগ এবং নির্বাচনের দাবিতে ২০১০ সালের ১২ মার্চ বিক্ষোভ দানা বাধলে তাতে ১৬ মার্চ প্রথম রক্তের ছোঁয়া লাগে। এদিন সরকারি অফিসগুলোতে নিজেদের রক্ত ছিটিয়ে অভিনব প্রতিবাদ জানায় লাল শার্টধারীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ৭ এপ্রিল ব্যাংককে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ১০ এপ্রিল জরুরি অবস্থা অমান্য করলে সেনাবাহিনী অভিযান চালায়। এতে সাংবাদিকসহ ২৫ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ১৪ নভেম্বর নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেও উপপ্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যাবস্থা না নেওয়ায় বিক্ষোভ চলতেই থাকে। এমতাবস্থায় ১২ মে সরকার নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য ও যানবাহন চলাচল সীমিত করে দেয়। ১৩ মে রাতের আধারে পুনরায় বিক্ষোভ দমন অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। দুই মাসব্যাপী এ বিক্ষোভে প্রায় একশ জন নিহত এবং হাজারেরও অধিক আহত হয়। দেশটির ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশিদিন চলতে থাকা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ।
সেনাবাহিনীর উদ্যত অস্ত্রের সামনে এক লালশার্টধারী যুবক
আরব বসন্ত : তিউনিসিয়ার ২৬ বছরের যুবক বুয়াজিজির বিদ্রোহ থেকেই ‘আরব বসন্ত’ নামের গণজাগরণের সূচনা। মিসরের গণজাগরণের পেছনেও রয়েছে এমনই এক যুবকের আত্মত্যাগ। তিনি খালেদ সাইদ। মিসরের এক পুলিশ কর্মকর্তার মুঠোফোন হ্যাক করে খালেদ দুর্নীতির এক ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করেন। এই ভিডিওচিত্রে মাদকদ্রব্য ব্যবসায় পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। খালেদের এই গোপন তৎপরতায় পুলিশ ক্ষুব্ধ হয় এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে খালেদ মারা যায়। ঘটনাটি গভীরভাবে স্পর্শ করে আরেক যুবক গুগলের নির্বাহী ওয়ায়েল ঘনিমকে। খালেদকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি ফেসবুকে ‘উই আর অল খালেদ’ নামে একটি পেজ খোলেন। এভাবেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূত্র ধরে মিসরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি কায়রোর ঐতিহাসিক তাহরির স্কয়ারে দিনভর বিক্ষোভের ডাক দেন ঘনিম। শুরু হয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলন।