ক্রীড়া প্রতিবেদক: ‘হিরো’ নামে তাসকিনকে ডাকেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। নিজের ছেলের মতই তাসকিনকে যেমন আদর করেন, ঠিক তেমন শাসন করেন। তাসকিনকে নিয়ে মাশরাফির বিশাল স্বপ্ন। মাশরাফি বিশ্বাস করেন জাতীয় দলের হয়ে আগামী দশ বছর খেলবেন তাসকিন। ‘হিরো’ হয়ে উঠবেন বিশ্ববরেণ্যে পেসারদের একজন। বাবা যেমন সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, তাসকিনকে নিয়েও মাশরাফি স্বপ্ন বুনছেন।
একটা ঘটনা বলি, বিপিএলে তাসকিনের পারফরম্যান্স আহামরি ছিল না। কিন্তু হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ছিলেন ডানহাতি এ পেসার। বিপিএলের পর মাশরাফির সঙ্গে তাসকিনের দেখা বিসিবির কোনো এক কক্ষে। তাসকিনের সঙ্গে ছিলেন বাবা আব্দুর রশিদ। বাবার সামনে মাশরাফি তাসকিনকে শাসন করে বলেন, ‘লাফালাফি একটু কমিয়ে খেলায় মনোযোগ দাও। অন্যথায় পরিণাম খারাপ হয়ে যাবে।’ সেদিনে তাসকিন মাশরাফির শাসনটা গায়ে লাগিয়েছিলেন ঠিকই।
বিশ্বস্ত সূত্রের খবর যে, বিসিবির নির্বাচক প্যানেল শুরুতে এশিয়া কাপে তাসকিনকে দলে নিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছিল! কিন্তু মাশরাফির কথায় তাসকিনকে স্কোয়াডে জায়গা করে দেন নির্বাচকরা। সেদিনের শাসন এতটাই কাজে দিয়েছিল যে এশিয়া কাপে তাসকিন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মূল অস্ত্র, মাশরাফির নির্ভরতার প্রতীক। জয়ের ভিত শুরুতেই গড়ে দিচ্ছিলেন তাসকিন। নিখুঁত লাইন ও লেংন্থ মেনে বোলিং করছিলেন। তার বাউন্সগুলো ছিল বেশ কার্যকরী। এশিয়া কাপে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রিকেটাররা তাসকিনের মুহুমুহু আক্রমণে হয়েছিলেন অতিষ্ঠ।
পারফরম্যান্সের ধারাবাকিতায় বিশ্বকাপের শুরু থেকেই তাসকিন ছিলেন অনন্য। কিন্তু দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপে খেলতে এসে তাসকিনকে ভয়ংকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হল। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল(আইসিসি) তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ কারণ তার বোলিংয়ে সাময়িক নিষিদ্ধ করেছে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। বিশ্বমঞ্চে এরকম এক ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। পুরো বাংলাদেশ দল হতভম্ব।
সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বিন মুর্তজা সব সময় প্রাণবন্ত থাকেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সোমবারের ম্যাচের আগে মাশরাফি ছিলেন একেবারেই ভিন্ন। মুখে কথা আটকে যাচ্ছিল। কথায় জড়তা কাজ করছিল। বারবার ক্যামেরায় মুখ লুকাচ্ছিলেন। ২৫ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে এর আগে এমনটা কোনো সময়ই দেখা যায়নি। সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময়েই তাসকিনকে নিয়ে প্রশ্ন। মাশরাফিও উত্তর দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো উত্তরই শেষ করতে পারছিলেন না টাইগার দলপতি।
তাসকিনকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন,‘আমার বিশ্বাস তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন সম্পূর্ণ বৈধ। আমি কথা বলছি যাকে নিয়ে সে আগামী ১০ বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সার্ভিস দিবে। যে ছেলেটা শেষ আটটি ম্যাচ আমাদের হয়ে দারুণ শুরু করেছে, আমাদের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে তাকে ছাড়া আমাদের নামতে হচ্ছে কালকের ম্যাচে। এটা আমাদের জন্যে বড় আঘাত। এটা এমন একটা সময় আমাদের কাছে এসেছে যখন ওদের ম্যানেজ করা আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে গেছে।’
তাসকিন ও আরাফাত সানীকে নিয়ে মাশরাফি আরও বলেন,‘আপনার বাসার দুটি ছেলে যদি কোনো সমস্যায় পড়ে তাহলে আপনি কোনো কাজে এগুতে গেলে পুরনো উদ্দ্যোমটা পাবেন না। আমাদের দলের অবস্থা এখন সেরকম। আমাদের দলের মানসিক অবস্থা খুব ভালো নেই।’
সংবাদ সম্মেলনের শেষে মঞ্চ থেকে নামতে নামতে মাশরাফি অঝোরে কেঁদেই ফেললেন। চোখ মুছছিলেন পড়নের জার্সি দিয়ে। মাশরাফি ও ম্যানেজার সুজন বাদে পুরো দল চলে গিয়েছিলেন টিম বাসে। কিন্তু দুজনের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে মাশরাফি মুখ লুকাতে পারলেন না। দুই চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছিল জল। বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা মাশরাফিকে সান্তনা দিচ্ছিলেন, ধৈর্য্য রাখতে বলছিলেন। মাশরাফির কান্নায় তারাও কান্না থামাতে পারছিল না। পুরো পরিবেশ গম্ভীর হয়ে উঠল নিমিষেই। সন্তানসুলভ তাসকিনের জন্যে মাশরাফি নিজেও কাঁদলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকদেরও কাঁদালেন।