প্রিয়আলো ডেস্কঃ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফুল ফোটার সঙ্গে বসন্তের সম্পর্ক নিরূপণ করতে রাজি নন। তিনি তাই ব্যাকুল হয়ে ফুল ফোটার তোয়াক্কা না করে অনায়াসেই বলতে পেরেছেন_ ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত’।
আমরা সবাই জানি, ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। বর্ষ পরিক্রমায় ছয় ঋতুর সঙ্গে আমরা এ বঙ্গের মানুষ যেভাবে পরিচিত হতে পারি সেভাবে বিশ্বের আর কোনো দেশের অধিবাসীরা ঋতুবৈচিত্র্যের এমন নিসর্গ অনুভূতি লাভের সুযোগ পায় না। তাই হয়তো তারা আমাদের মতো করে ঋতুর বন্দনা বা উৎসব পালনের কথা চিন্তাও করে না। যা হোক, আমরা ছয়টি ঋতুর এমন বিচিত্র ব্যাপকতা লাভে সৌভাগ্যবান হলেও ঋতুবিচারে আমাদের সবার কাছে বসন্ত পেয়েছে আলাদা সমীহ। ঋতুরাজের অভিধায় তাই তাকে আমরা ভূষিত করেছি।
বসন্তের আগমনে নীরব প্রকৃতি যেন সরব হয়ে ওঠে। গাছে গাছে নবপল্লব, পাখ-পাখালির কলকাকলি, কোকিলের কুহুকুহু শব্দ মনের গহিনে তাই দোলা দিয়ে যায়। ফাগুনে প্রকৃতির এমন পরিবর্তন মানবমনেও অদ্ভুত এক শিহরণ জাগায়। আর তা কবিগুরু তার গানে ব্যক্ত করলেন এভাবে_ ‘আহা আজি এ বসন্তে/এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…’।
বসন্ত যখন আসে তখন মানবমনে এক অপার্থিব, অব্যক্ত অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে তারুণ্যের হৃদয়ে তা উথাল-পাথাল ঢেউ তোলে। মনে হয় এই বুঝি কী জানি কী হয়! কী যেন কী পেতে চায়! বন্ধুত্ব নাকি প্রেম, ভালোলাগা নাকি ভালোবাসার অনুভূতি, নিজেকে মেলে ধরা নাকি হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি_ এমন বোঝা-না বোঝার দোলাচলে তা সবসময় বয়ে চলে। তবে হৃদয় মেলে দিয়ে, বন্ধ জানালা খুলে দিয়ে বসন্তকে বরণ করে নিতে জানলে তখন সে অনুভূতি হয় দৃশ্যমান, অপার্থিব। জীবন হয়ে ওঠে মধুময়। তাই তারুণ্য যেমন চায় বসন্তের ছোঁয়া তেমনিভাবে বসন্তও আশা করে তারুণ্য তাকে একান্তই নিজের করে নিক। নিজের মতো করে উদযাপন করুক। তারুণ্যের পরশে সে হয়ে উঠুক আরো মোহনীয়, বর্ণিল। এজন্যই বিশ্বকবি তার ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ কবিতায় আমাদের বসন্তের আগমনী ধ্বনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে উদার হৃদয়ে তাকে বরণ করার সুস্পষ্ট তাগাদা দিচ্ছেন এভাবে_ ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে/আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো/আজি ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো…’।
বসন্ত শুধু বাংলার প্রকৃতিতেই তার সর্বপ্রভাব বিস্তার করে বিষয়টি এমন নয়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসন্ত যেভাবেই আসুক না কেন প্রকৃতি ও মানবমনে তার প্রভাব হয়তো একই রকম হয়ে থাকে। নীরবতা বা জড়তা ভেঙে প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়।
ফাগুন যখন আসে তখন কৃষ্ণচূড়া, হিজল, তমাল, পলাশের ডালে ডালে ফুল ফোটে। ফুল ফোটে বনের নাম জানা বা অজানা তরুলতায়। কচি পাতার ফাঁকে ফুলের এমন সমারোহ সত্যিই দারুণ ব্যাপার। চোখ জুড়িয়ে যায়।
এ বসন্তেই আমাদের পূর্বসূরি তরুণরা তাদের রক্ত দিয়ে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তবুও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তার আপন মহিমায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের সেই রক্তসিঁড়ি বেয়েই পরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাই আমাদের কাছে ফাগুন আসে আনন্দ ও বেদনার মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে। এজন্য কৃষ্ণচূড়ার লাল রং যেন প্রতীকী রক্তের রং হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। আমরা আবেগাক্রান্ত হই।
তারুণ্যের উন্মাদনা ও ব্যাপক অংশগ্রহণে সে রূপ আরো পূর্ণতা পাক সে প্রত্যাশা রেখে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কবিগুরুর সুরে সুর মিলিয়ে আসুন গেয়ে উঠি_ ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন ঘটাতে’। বিভেদ নয়, ঐক্য; সংঘাত নয়, শান্তি_ এ প্রত্যাশা নিয়ে আসুন উদযাপন করি এবারের ফাগুন।