‘ওর বাবার (স্বামীকে বুঝিয়েছেন) কোলে পিচ্চিটা। সাততলা থেকে দৌড়ে নামছি আর চিৎকার করছি। প্রথমে চারতলা ও পরে তিনতলায় ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়লাম। ওরা দরজা খুলল। আমাগো দেইখ্যা দরজাগুলো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। সব স্পষ্ট মনে আছে। বিল্ডিংয়ের নিচে নামলাম। দেখলাম কত মানুষ। কেউ এগিয়ে আসল না। সবাই তাকাইয়্যা রইল। পুরা কাপড় তো পুইড়্যা গেল। একটা চটের বস্তা দিয়া শরীরটা জড়াই। আল্লাহ মাফ করুন। মানুষ কত অমানবিক। বিল্ডিংয়ের মহিলারা একটা চাদরও আগাইয়্যা দিল না। বললাম_ আমি মহিলা; অন্তত একটা চাদর দেন। কিচ্ছু দিল না। নইলে
ওদের একটা চাদর বা তোষকই পুড়ত। আমার বাচ্চারা তো বাঁচত। একটা মানুষও সাহায্য করেনি।’ উত্তরার বাসায় গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া আক্তার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে গত সোমবার রাতে তার স্বজনদের কাছে সেই দিনের ঘটনার এমন দুঃসহ বর্ণনা করলেন। এতে আরেকবার নগরজীবনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার এক কঠিন এবং রূঢ় চিত্র যেন উঠে এলো।
সুমাইয়ার বক্তব্যের শেষ চার বাক্য ছিল_ ‘মানুষ এরকম হয়। এ কী রকম খারাপ। কেউ কারও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। এটা একটা কথা।’ তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। চিকিৎসকরা তার বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। তবু স্বজনরা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল সুমাইয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে সিটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরই মধ্যে উত্তরার ওই ট্র্যাজেডিতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তার স্বামী প্রকৌশলী শাহীন শাহনেওয়াজ ও দুই সন্তান ১৫ বছরের সারলিন বিন নেওয়াজ ও এক বছর চার মাস বয়সী জায়ান বিন নেওয়াজ। আরেক সন্তান জারিফ কেবলই আশঙ্কামুক্ত। এরই মধ্যে সুমাইয়াও আন্দাজ করছেন_ তার দুই সন্তান ও স্বামী বেঁচে নেই। এ জন্য সন্তানদের বাঁচানো গেল না বলে আক্ষেপও করছেন তিনি।
হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় থেকে সুমাইয়ার সেই দুঃসহ স্মৃতির বিষয়টি উল্লেখ করে গতকাল ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট দিয়েছেন তার খালাতো ভাই খিরকিল নওয়াজ। একই পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন_ ‘সুমাইয়া তার নিকটজনের কাছে সেদিনকার ঘটনা বর্ণনা করে। চলুন শুনি সুমাইয়ার মুখে সেদিন আসলে কীভাবে আগুন লেগেছিল। কাদের অবহেলার জন্য এইভাবে নিঃশেষ হয়ে গেল একটি পরিবার। সারা শরীরে আগুন নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সাহায্য চেয়েছিল, কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকি বাড়ির দারোয়ানও না। বিবেক আর মানবতা কোথায়? এটা পরিষ্কার যে, কিচেনের চুলার কারণে নয়, অন্য কোনো কারণে ঘটতে পারে এই দুর্ঘটনা। নিরপেক্ষ তদন্তে বেরিয়ে আসবে সবকিছু।’
ফেসবুকে আংশিক ভিডিও দিলেও ২৮ মিনিটের পুরো অডিও সমকালের হাতে এসেছে। এতে খুব কষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় সুমাইয়া বলেন_ ‘বাসায় গ্যাসের পাওয়ার কম ছিল। তিন দিন বাইরে থেকে খাবার কিনে খাই। সমস্যা জানানোর পর মিস্ত্রি এসে পাওয়ারফুল রাইজার লাগিয়ে দিয়ে যায়। এরপরও বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেতাম। গ্যাসের পাইপে লিক ছিল। ঘটনার আগের দিন রাতেও বাসায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেছে। ওর বাবা বলছে, ছাদে গ্যাসচালিত গিজারের ট্যাংক আছে, গন্ধ সেখান থেকে আসতে পারে। আমরা তো রান্নার সময় ছাড়া চুলা সবসময় বন্ধ রাখি। ঘটনার দিন সকালে নামাজ পড়ে চা বানানোর জন্য চুলায় পানি দেই। ওর বাবা সকাল পৌনে ৭টায় বাসা থেকে বের হওয়ার কথা ছিল। রান্নাঘরের জানালা খোলা। সকালে রান্নার সময়ও ঘরে গ্যাসের গন্ধ। জারিফের বাবা বলছে_ গ্যাসের গন্ধ; ফ্যান ছেড়ে দিই। ফ্যান ছাড়ার পর চুলার কাছে যাই। এর পরই সেকেন্ডের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ছোট ছেলেটা ওর বাবার কোলে। দুই ছেলে পাশের দুই রুমে ছিল। আগুন লাগার পর ওদের রুমগুলো যেন বন্ধ হয়ে গেল। পুরো ঘরে আগুন। ওর বাবা আমাকে বলল_ দরজা খোল। ছোট ছেলে, ওর বাবা ও আমি চিৎকার করে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে নিচে নামতে থাকি। কেউ সাহায্য করল না। তিন ও চারতলার ফ্লোরে ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলল। আমাদের গায়ে আগুন দেইখ্যা ওরা দরজা বন্ধ করে দিল। আমরা তো সাততলা থেকে নামলাম। তিন বা চারতলায় তো আগুন লাগেনি। ওরা অন্তত একটা তোষক আমাদের গায়ে জড়াইয়্যা ধরতে পারত। তাগো নাহলে একটা তোষকই পুড়ত। নিচে নামলাম। দেখি চটের বস্তা ঝুলে আছে। টান মাইর্যা গায়ে জড়ালাম। দারোয়ানকে চিল্লাইয়্যা বললাম_ আমার দুইটা ছেলে ওপরে আটকা পড়েছে। ওরা যাইতে যাইতে সব শেষ। সারলিন বেশি পুড়েছে। ওর গায়ে ও পায়ে থকথক করছিল। সারলিন নেমে আসে। এরপর নেমে আসে জারিফ। সারলিন বলে কি_ আম্মু আমি তো বাঁচব না। আমাকে মাফ করে দিও আম্মু। আমি বলি, বাবা তুমি বাঁচ; আমি মইর্যা যাই।’
সুমাইয়ার চাচাতো ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা খিরকিল নওয়াজ সমকালকে বলেন, প্রতিবেশীরা কত নিষ্ঠুর হতে পারে_ এ ঘটনায় সেটা দেখা গেল। দগ্ধদের আকুতি দেখে পরে মনিরুজ্জামান নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি তাদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। দুর্ঘটনার পর প্রথম থেকে প্রচারণা ছিল_ অসতর্ক অবস্থায় গ্যাসের চুলা খোলা রাখায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আসলে সেটা নয়। গ্যাসের চুলা খোলা ছিল না। এ ছাড়া রান্নাঘরের ওপরে দেড় ফুট বর্গাকৃতির স্থায়ী ফাঁকা জায়গা রয়েছে। বাসার গ্যাসের লাইনে সমস্যা ছিল। সেটা ভাড়াটিয়াদের অসতর্কতা বলে চালান হয়। সুমাইয়া যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট সেখানে কী ঘটেছে।
শাহনেওয়াজের ভাতিজা রাহাত মেহেদী বলেন, এখনও সুমাইয়াকে তার দু্ই সন্তান ও স্বামীর কথা জানানো হয়নি। তবে সে বারবার ওদের কথা বলছে। সোমবার মোবাইলে জারিফের সঙ্গে কথা বলেছেন তার মা। এরপর একটু শান্ত আছেন। মাস্টার বেডরুমে থাকায় জারিফ বেঁচে গেছে।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন সমকালকে বলেন, কেন এবং কী কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে_ তা উদ্ঘাটনে আলামত পরীক্ষা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়।