নিজস্ব প্রতিবেদক : বেগম মাহফুজা মালেক ঠান্ডা মাথায় নিজ হাতেই তার দু’ সন্তানকে হত্যা করেছেন। নিজের ব্যবহৃত ওড়না শিশুদের গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করে পরে নিজে বাঁচার চেষ্টা করেন। ঘটনা ভিন্নখাতে নেয়ারও চেষ্টা চালান।
বৃহস্পতিবার উত্তরায় র্যাব হেডকোয়ার্টার্সে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। সোমবার রাজধানীর রামপুরায় বনশ্রীতে নুসরাত আমান অরনী (১৪) এবং আলভী আমান (৭) এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘দুই শিশুর ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল ঘটনার সঠিক রহস্য উদঘাটনের জন্য ঢাকা নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে শিশু দুটির গৃহশিক্ষিকা শিউলি আক্তার, খালু নজরুল ইসলামের ভাগ্নে শাহিন, মেয়ের মার মামাতো ভাই মো. ওবায়দুল ইসলাম, বাসার দারোয়ান পিণ্টু মণ্ডল, অপর দারোয়ান ফেরদৌসকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে আসে। জামালপুর থেকে শিশুদের পিতা-মাতা ও খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জানা যায় যে, বেগম মাহফুজা মালেক সর্বদা তার সন্তানদের স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাযুক্ত থাকতেন। ধারণা ছিল, তার সন্তানেরা বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও জানান, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি অরনীর গৃহশিক্ষিকা চলে যাওয়ার পর অরনী তার পিতা-মাতার বেড রুমে ৫টার দিকে ঘুমাতে যায়। তখন বাসায় তারা দুভাইবোন, মা মাহফুজা ও বৃদ্ধা দাদী ছিলেন। একই সময়ে আলভি আমান বেড রুমে বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। মাহফুজাও ছেলের সাথে একই বিছানায় শুয়ে ছিলেন। অরনী মায়ের সাথে ঘুমানোর জন্য বিছানায় শোয়। মাহফুজা কিছু সময় পর অরনীর গলায় ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে উভয়েই বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। কিছু সময় পর মেয়ের শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে তিনি ছেলে আলভিকে খাটের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় একইভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি লাশ দুটির সামনে কিছু সময় ধরে কান্নাকাটি করেন।
হত্যাকাণ্ডের পর নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রথমে ফোন করে স্বামী আমানউল্লাহকে জানান, ছেলে-মেয়ে কেমন জানি করছে। স্বামীর বাসায় ফিরতে দেরি হবে জেনে তিনি তার মা ও নিজ বোন মিলাকে ফোন করে বিষয়টি জানান। মাহফুজা তাদের বলেন, দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমানোর পর তার সন্তানরা আর ঘুম থেকে উঠেনি। আগের দিন রাতে আনা খাবারের বিষক্রিয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করেন।
র্যাবের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি মাহফুজার বিবাহবার্ষিকী ছিল। ১৪তম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে পরিবারের সকলে ওইদিন বনশ্রীর ক্যান্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে যান। খাওয়ার পর অবশিষ্ট খাবার সেখান থেকে সাথে করে নিয়ে বাসায় আসেন।
মাহফুজা গল্প ফাঁদেন যে, ২৯ ফেব্রুয়ারি অরনী এবং আলভী দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর রেস্টুরেন্ট থেকে আনা অবশিষ্ট খাবার খেয়ে ঘুমাতে যায়। বিকালে ডাকাডাকির পর তারা ঘুম থেকে না উঠায় পরিবারের সদস্যদের মোবাইল ফোনে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি দাবি করেন যে, রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়া জনিত কারণে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। শিশু দুটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য আল রাজী হাসপাতাল, বনশ্রীতে নিয়ে যান তাদের বাবার বন্ধুরা। আল রাজী হাসপাতাল থেকে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশু দুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপমৃত্যুর কারণে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃতদেহ দুটি ময়নাতদন্ত করার জন্য মর্গে পাঠায়। তাদের বাবা ও মা গ্রামের বাড়ি জামালপুরে চলে যান। ময়নাতদন্তের রির্পোটে বলা হয়, শিশু দুটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের গলায় ফাঁসের চিহ্ন রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, মাহফুজা উচ্চশিক্ষিত। তিনি শিক্ষকতাও করেছেন। এ কারণে পড়াশোনার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। নিজ সন্তানদের বেলায় এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রাথমিক তদন্তে এটিই হত্যার কারণ বলে মনে হচ্ছে। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত: গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রীতে দুই ভাই-বোন নুসরাত আমান অরনী (১২) এবং আলভী আমান (৭) মারা যায়। তাদের মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়।