রাজনীতি :বিএনপির দু’দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনের পর প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দীর্ঘদিন পর দল সম্পর্কে নিজেদের মূল্যায়ন প্রকাশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের তুলোধুনো করেছেন তৃণমূল থেকে আসা কাউন্সিলররা।
বিগত আন্দোলনে পুরো ব্যর্থতার দায়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর চাপিয়ে তারা বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠনের অপেক্ষা থাকা কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ্য ও ত্যাগীদের দেখতে চেয়েছেন।
শনিবার রাতে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের দ্বিতীয় পর্বে কাউন্সিলরদের ‘ক্লোজড ডোর’ মূল্যায়ন সভায় তারা এই ধরনের মন্তব্য করেন।
‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’-এই স্লোগানকে সামনে রেখে বেলা ১১টার দিকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন ও কবুতর উড়িয়ে কাউন্সিলের উদ্বোধন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময় জাতীয় ও দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।
এরপর ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’ শীর্ষক কাউন্সিলের থিম সং গাওয়া হয়। এটি পরিবেশন করে বিএনপির অন্যতম অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস।
সকাল ১০টায় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়ে চলে মধ্যহ্নভোজ পর্যন্ত। দুপুরে ঢাকার বিখ্যাত ‘মোরগ-পোলাও’ খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়।
বিএনপির বিগত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকার সমালোচনা করে নাটোর বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘স্বাধীনতা পর এমন বড় আন্দোলন আর হয়নি। আন্দোলনের ডাক দিলে ১৫ দিনেই সরকার পতন হবে বলে যারা মন্তব্য করেছিলেন, আন্দোলনের সময়ে তারা মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে পালিয়ে থেকেছেন।’
ভবিষ্যতে যারা আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারবে তাদেরকে কমিটিতে আনতে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন্দ কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি কমিটিতে কোনো ধরনের বেঈমান-মীর জাফরদের দেখতে চাইনা। আন্দোলনের জন্য তৃণমূল প্রস্তুত আছে। তৃণমূল কখনো বেঈমানি করেনি।’ এ সময় এক নেতার এক পদ রাখার পক্ষে মত দেন তিনি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম বিশ্বাসঘাতক দেখতে খুব বেশি দূরে যেতে হবেনা। আশে পাশে তাকালেই দেখতে পাবেন।’
মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার সভাপতি খান মনিরুল মনি বিএনপির মধ্যে মুখোশধারীদের চিহ্নিত করার দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘তৃণমূল আন্দোলন করে, হামলা-মামলা মোকাবেলা করে জেল খাটে আর কেন্দ্রীয় নেতারা শুধু টেলিভিশনে মুখ দেখায়। অথচ তারা বড় বড় পদ দখল করে আছে। তাদের আন্দোলনেও পাওয়া যায়না, বাসায় দেখা করতে গেলেও পাওয়া যায়না। ঠিকানা বদলে অন্য জায়গায় চলে যায়।’
কাউন্সিলের দ্বিতীয় পর্বে চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের ফলাফল বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের প্রতিবেদন পেশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় এবং দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সংশোধন হয়। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ, প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা, বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে মুক্ত আলোচনা, সাংগঠনিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেন কাউন্সিলররা।
মহাসচিবের সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশের প্রসঙ্গ ধরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এই রিপোর্টে ব্যর্থতার কারণগুলো তুলে ধরা উচিত ছিল। এতো বড় কেন্দ্রীয় কমিটি অথচ আন্দোলনের কেউ নাই।’
ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তৈমুর আলম খন্দকার প্রশ্ন রাখেন- বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে থাকার পর হঠাৎ করে কেন সেখান থেকে সরে আসা হলো? কেন্দ্রীয় নেতাদের কারা তখন পরামর্শ দিয়েছিল তা জানতে চান তিনি।
আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়ী করে রাঙামাটির পার্বত্য সদরের সভাপতি মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আন্দোলনে সময়ে রাতে আধারে ম্যাচ ফিক্সিং হয়েছে। না হলে বিএনপি জিততো। আমরা টেস্ট খেলতে চাইনা, টি-টোয়েন্টির মতো খেলতে চাই।’
গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার সভাপতি হুমায়ুন কবির খান বলেন, সাংগঠনিক প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার আগে আন্দোলনে ব্যর্থতার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা দরকার। ক্ষমতাসীনরা ‘বেঈমানির কারণে’ তোফায়েল আহমেদের মতো নেতাদের ‘সাইজ’ (ব্যবস্থা) করতে পারলে বিএনপি কেন ‘বিশ্বাসঘাতকদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেনা-সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
প্রায় ছয় বছর পর এই কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে নেতাকর্মীদের মাঝে। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠান শুরু করার কথা থাকলেও ভোর থেকেই রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে তারা আসতে শুরু করেন। কাউন্সিলের সফলতা প্রত্যাশা করে নেতাকর্মীদের টানানো ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে ফেলা হয় পুরো অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশের এলাকা।
কাউন্সিলে বিএনপির নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমজের প্রতিনিধি, আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে খালেদা জিয়া চেয়ারপরসন এবং খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন হন বিএনপির মহাসচিব।
তিন বছর মেয়াদি কমিটির সময় আড়াই বছর আগেই শেষ হয়েছে। এর আগে দুই দফা কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কাউন্সিল হয়। দ্বিতীয় কাউন্সিল হয় ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর এর আট বছর পর ১৯৮৯ সালের ৮ ও ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দলটির তৃতীয় কাউন্সিল। ১৯৯৩ সালের ১, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি চতুর্থ কাউন্সিল করে। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর হয় পঞ্চম কাউন্সিল।