বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে ৭১ রানে হারিয়ে ১২ বছর পর ফাইনালে উঠেছে ভারত। সেই সাথে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের সেমিতে কিউইদের কাছে হারের প্রতিশোধ নিলো রোহিত শর্মার দল। আগে ব্যাট করতে নেমে ভিরাট কোহলি ও শ্রেয়াস আইয়ারের জোড়া সেঞ্চুরি এবং শুভমান গিলের হাফ সেঞ্চুরিতে ৩৯৭ রানের পাহাড় গড়ে ভারত। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ড্যারিল মিচেলের সেঞ্চুরি করলেও ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ শামির বোলিং তোপে ৭ বল বাকি থাকতেই ৩২৭ রানে গুটিয়ে যায় কিউইরা। শামি একাই নেন ৭ উইকেট। এর ফলে বিশ্বকাপে দশ ম্যাচে দশ জয়ে অপরাজিত থেকেই ফাইনালে পৌঁছালো মেন ইন ব্লু’রা।
বুধবার (১৫ নভেম্বর) মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের দেয়া ৩৯৮ রানের বড় লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা দেখেশুনেই করেন নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার ডেভন কনওয়ে ও রাচিন রবিন্দ্র। তবে রান তোলার চাপে শেষ পর্যন্ত বিদায় নেন কনওয়ে। ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে মোহাম্মদ শামির অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাউভ করতে চেয়েছিলেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ব্যাটে- বলে ঠিকঠাক না হওয়ায় এজ হয়ে উইকেটের পেছনে থাকা লোকেশ রাহুলের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। আউট হওয়ার আগে ৩টি চারে ১৩ রান করেন এই বাঁহাতি ওপেনার।
আরেক ওপেনার রাচিন রবীন্দ্রও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। শামির দারুণ এক ডেলিভারিতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রাহুলের গ্লাভসে। দারুণ ছন্দে থাকা তরুণ এই ওপেনারের ব্যাট থেকে আসে ১৩ রান। দ্রুত দুই উইকেট হারানোর পর নিউজিল্যান্ডকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন উইলিয়ামসন এবং মিচেল। কাজটা দারুণভাবে করেছেনও তারা দু’জন। সময় যত বেড়েছে নিউজিল্যান্ডের রান তোলার গতি ততই বেড়েছে। উইলিয়ামসন খানিকটা ধীরগতিতে ব্যাটিং করলেও মিচেল প্রায়শই ভারতীয় বোলারদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। ৪৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি পাওয়ার পর রান তোলার গতি আরও বাড়িয়ে দেন তিনি। তাকে দারুণভাবে সঙ্গ দেয়া উইলিয়ামসন হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ৫৮ বলে। অন্যপ্রান্তে দারুন ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরিও তুলে নেন মিচেল। মাত্র ৮৫ বলে তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগার স্পর্শ করেন ডানহাতি এই ব্যাটার।
ভারত যখন এই দুজনের জুটি ভাঙতে মরিয়া তখন উইলিয়ামসনের ক্যাচ মিস করেন শামি। যদিও পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ককে সাজঘরে পাঠান ডানহাতি এই পেসারই। শামির লেগ স্টাম্পের বলে স্কয়ার লেগ দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সুরিয়া কুমার যাদবের হাতে ধরা পড়েন ৬৯ রানের ইনিংস খেলা উইলিয়ামসন। একই ওভারে টম লাথামকে সাজঘরে ফেরান শামি। ভারতীয় এ পেসারের দারুণ এক ডেলিভারিতে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়েন কিউই এই উইকেটকিপার ব্যাটার।
গ্লেন ফিলিপসকে নিয়ে তারপরও নিউজিল্যান্ডকে কক্ষপথেই রেখেছিলেন মিচেল। ৪১ রান করা ফিলিপসকে ফিরিয়ে ভারতকে ব্রেক থ্রু এনে দেন জসপ্রিত বুমরাহ। এরপর নিউজিল্যান্ডের শেষ স্বীকৃত ব্যাটার মার্ক চ্যাপম্যানও আউট হয়ে যান মাত্র ২ রান করে। তখনই মূলত ম্যাচ হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যায় কিউইদের। একপ্রান্ত আগলে খেলতে থাকা মিচেলকে ফিরিয়ে ৫ উইকেট স্পর্শ করেন শামি। আউট হওয়ার আগে মিচেলের ব্যাট থেকে আসে ১১৯ বলে ১৩৪ রানের ইনিংস। তার ইনিংস জুড়ে ছিল ৭টি ছক্কা ও ৯টি চারের মার।
এরপর আর কেউ দাঁড়াতে পারেননি। মিচেল স্ট্যান্টনারও ফিরে গেলে বড় হার সঙ্গী করেই বিশ্বকাপে পথচলা শেষ হয় কিউইদের। নিউজিল্যান্ডের শেষ দুই উইকেট তুলে নিয়ে শামি নিজের বোলিং শেষ করেন ৫৭ রানে ৭ উইকেট নিয়ে। আর তাতেই নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে যায় ৩২৭ রানে। ভারতের হয়ে একটি করে উইকেট নেন জসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজ ও কুলদীপ যাদব।
এর আগে, টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের প্রথম ওভারেই ট্রেন্ট বোল্টকে পরপর দুই বলে দুই বাউন্ডারি মেরে ঝড়ের পূর্বাভাস দেন রোহিত শর্মা। ভারতীয় অধিনায়কের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে মাত্র ৩২ বলে দল ও উদ্বোধনী জুটির রান পঞ্চাশ স্পর্শ করে। ওয়াংখেড়ের স্লো-উইকেটে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। বোল্ট-সাউদিরা পিচ থেকে সুইং আদায় করে নিতে পারেননি। তাদেরকে বেধড়ক পেটাতে থাকেন রোহিত। তবে রোহিত ঝড় থামান সাউদি। এই কিউই পেসারের স্লোয়ার বলে টাইমিং করতে পারেননি ভারতীয় অধিনায়ক। টপ এজ হয়ে বল উঠে যায় অনেক উঁচুতে, মিড অফ থেকে অনেকটা পেছন দিকে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে দারুণ এক ক্যাচ নেন উইলিয়ামসন। ভাঙে ৫০ বল স্থায়ী ৭১ রানের জুটি। ২৯ বলে চারটি করে ছক্কা ও চারে ৪৭ রান করে সাজঘরে ফেরেন রোহিত।
এরপর গিলকে নিয়ে ভারতকে এগিয়ে নিতে থাকেন কোহলি। শুরুতে একটু ধীরগতিতে খেললেও ৪১ বলে ক্যারিয়ারের ১৩তম হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন গিল। দারুণ ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরির পথেই ছিলেন তরুণ এই ওপেনার। যদিও শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি। সিঙ্গেল নিতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভোগায় ৬৪ বলে ৭৯ রানের ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়েন গিল। কোহলিকে সঙ্গ দিতে চারে আসেন আইয়ার। তারা দু’জনে মিলে নিউজিল্যান্ডকে রীতিমতো চাপে ফেলে দেন। রাচিনের বলে সিঙ্গেল নিয়ে ৫৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন কোহলি। বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে যা তার প্রথম হাফ সেঞ্চুরি।
এরপর ৮০তম রান নেয়ার সময় কোহলি ছাড়িয়ে যান শচীন টেন্ডুলকারকে। ২০০৩ সালের আসরে ১১ ইনিংসে ৬৭৩ রান করেছিলেন টেন্ডুলকার। ২০ বছর পর এক ইনিংস কম খেলেই তাকে টপকে গেলেন কোহলি। এরপর ১০৬ বলে পান সেঞ্চুরির দেখা। একইসঙ্গে শচীনকে তিনি ছাড়িয়ে যান আবারও। বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ৫০টি শতক এখন কেবল ‘কিং’ কোহলির দখলে।
১২৮ বলে ১৬৩ রানের জুটি গড়ার পর সাউদির বল উড়িয়ে মারতে গিয়ে বিদায় নেন কোহলি। ১১৩ বলে ৯ চার ও ২ ছক্কায় ১১৭ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরেন এই মহাতারকা। তবে অন্যপ্রান্তে লড়াই চালিয়ে যান শ্রেয়াস। মাত্র ৩৫ বলে প্রথম ফিফটি ছুঁয়ে পরের ফিফটি পূর্ণ করেন ৩২ বলে। আসরে এটি তার টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। তবে সেঞ্চুরির পর ইনিংস বড় করতে পারেননি শ্রেয়াস। ট্রেন্ট বোল্টের বলে শর্ট বলে লং অনে ড্যারিল মিচেলের হাতে ধরা পড়েন এই মিডল অর্ডার ব্যাটার। ৭০ বলে ৮টি ছক্কা ও ৪টি চারে ১০৫ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন শ্রেয়াস।
শেষদিকে আবারও ব্যাট করতে নামেন ইনজুরিতে মাঠ ছাড়া গিল। তবে এই যাত্রায় তার ব্যাট থেকে আসে কেবল এক রান। আর লোকেশ রাহুলের ২০ বলে ৩৯ রানের ক্যামিওতে ৩৯৭ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় স্বাগতিকরা। নিউজিল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট শিকার করেন সাউদি। তবে বল হাতে সাউদি রান দিয়েছেন ১০০। বাকি উইকেটটি পান ট্রেন্ট বোল্ট।